কে দিল অভি ভরা নেহি – জন্মদিনে সুরকার জয়দেবকে মনে করে

-

তখন মধ্যবিত্ত বাঙালি বলে এক প্রজাতি বাস করতেন এই ধরাধামে। আমার ছোটবেলাতেও তাদের দেখেছি, বড় হয়েছি সেইরকম মধ্যবিত্ত বাঙালি বাবা মায়ের আদরে, শাসনে। ঠাসা বই আর ঠাসা ক্যাসেট এই ছিল অ্যাসেট।পুজোর সময় হয় বেড়াতে যাওয়া হত, না হলে একপিস জামা আর এক খানা ক্যাসেট – এই দ্বিতীয়টার জন্যই হা-পিত্যেশ করে থাকতাম। এমনিতে সারা বছর ষাট বা নব্বই মিনিটের ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেটে রেকর্ডিং করা হত পছন্দের গান, পছন্দের বাজনা। এই রকমই একটা পুজোতে, পঞ্চমীর দিন অফিস থেকে ফেরার সময়, বাবা কিনে আনলেন একটা ক্যাসেট। অ্যালবামের নাম শ্রদ্ধাঞ্জলী।

অ্যালবামের প্রচ্ছদে একজনের ছবি, তাকে অত অল্প বয়েসেই ঠাকুর দেবতা গোছের একজন বলে মানি – তার নাম লতা মঙ্গেশকর। বাকীদের গান শুনে থাকলেও ছবি দেখে সবাইকে চিনে উঠতে পারিনি। খুব সম্ভব সেই ক্যাসেটের সাইড বি এর প্রথম গানটা শুনে কান্না লুকতে লাগলাম, একী গান, একী সুর! লজ্জা লোকাতে অন্য ঘরে যাই কিন্তু যতবার শুনি এই গানের মুখরা – “..বাত নিকলি তো হর এক বাত পে রোনা আয়া, কভি খুদপে কভি হালাত পে রোনা আয়া” –  ভেতরের দলা পাকানো কান্না থামতে চায়না।কথা বোঝার বয়স হয়েনি কিন্তু ওই দুই গান্ধারের কান্নাই বোধহয় সেদিন কাঁদিয়েছিল আমায়।  বাবা বুঝতে পেরে  বুঝিয়েছিলেন, এ গান আদতে রফি সাহেবের গাওয়া আর সুরকার হলেন জয়দেব।

ওস্তাদ আলি আকবরের খান সাহেবের নিজের লেখায় রয়েছে যে, খান সাহেবের বম্বে ফিল্ম মিউজিকে কাজ করার মূলে রয়েছেন জয়দেব। জয়দেব নিজে একজন দক্ষ সরোদিয়া ছিলেন। প্রথমে আলমোড়া আর তার পরে লখণৌতে থেকে জয়দেব শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেন আলি আকবর খানের কাছে। কিন্তু বরাবরই বম্বে চলচিত্র জগৎ হাতছানি দিত তাঁকে। অভিনয়ও করেছেন কিছু ছবিতে।তারপর এক সময়ে তাঁর দুই প্রেম – সংগীত আর সিনেমা মিশে যায় এক অনন্য স্রোতে।

 সংগীত পরিচালক হিসেবে, শ্রী জয়দেব জন্ম দিতে থাকেন একের পর এক অভূতপূর্ব গানের। এর আগে অবশ্য সহকারী পরিচালক হিসাবে তিনি অ্যাসিস্ট করেছেন ওনার গুরু স্বয়ং আলি আকবর খান সাহেবকে এবং তার পর কিছুদিন সহকারী সংগীত পরিচালক হিসাবে কাজ করেন শচীন দেব বর্মনের সাথেও।

তখনকার দিনে সুরকার হিসাবে শাস্ত্রীয় সংগীত আর লোকসংগীত এই দুইয়েরই সঠিক জ্ঞান এবং বোধ থাকা ছিল খুবই প্রয়োজনীয়।এই দুই মহারথীর সান্নিধ্য যে জয়দেবের রচনায় কত ম্যাজিক জুড়েছিল তা গানগুলো শুনলেই বোঝা যায়। তবে কম্পোজিশনকে কখনো খেয়াল, ধ্রুপদ, ঠুমরী, মান্ড, বা বাউল খেয়ে ফেলেনি। গানের সুরগুলো তাই আজও গান হিসাবেই দাঁড়িয়ে আছে। শাস্ত্রীয় সংগীতের এমন খানদানি তালিম পাওয়া জয়দেবের গান শুনলে কখনো কিন্তু মনে হয়নি যে পিলুর ঠুমরী বা গৌড় মল্লারের দ্রুত খেয়ালের বন্দিশের জোড়া গান শুনছি বা তিলক কামোদের গৎ ভাঙা কোন গান শুনছি।

বহু দশক ধরে জয়দেবের সুর, সংগীত পাগল মানুষদের ছুঁয়েছে। লতা মঙ্গেশকরের সাক্ষাৎকারে যতবার সেই সময়ের প্রিয় সুরকারের প্রসঙ্গ এসেছে, তত বার মদন-মোহন, সি রামচন্দ্র আর জয়েদেব – এনাদের নাম উঠে এসেছে। শাহির লুধিয়ানবি থেকে গুলজার আবার মোহম্মদ রফি থেকে সুরেশ ওয়াদেকর, বা লতা মঙ্গেশকর থেকে আশা ভোঁসলে, জয়দেবের সাথে যে কোন কেমিস্ট্রিতেই তৈরি হয়েছে একের পর এক গান রত্ন। 

আজ, শ্রী জয়দেবের একশ তিন বছরের জন্মদিনে ওনার সুর করা গান মনে করতে গিয়ে একে একে মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক অনেক গান, অবশ্যই হাম দোনো ছবির “আল্লা তেরো নাম”, আবার চান্দ গ্রহণ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরেরই গাওয়া “আ প্যায়ারকি বাঁহো মে”, আবার এই ছবিরই “ম্যায় জানু নাহি”  গানটার আগের সেই কয়েক সেকেন্ডে সেতারের তার সপ্তক ছোঁয়ার মূর্চ্ছণ, সরস্বতী পুজোর ভোরের ভৈরবীতে আলাপ ছবির গান “মাতা সরস্বতী সারদা”,  ঘরোন্দা ছবিতে ভূপিন্দর সিং এর গলায় কালজয়ী গান “এক একেলা ইস শহর মে”  আবার গমন ছবিতে ছায়া গাঙ্গুলীর গলায় “আপ কি ইয়াদ আতি রহি”  বা  সুরেশ ওয়াদেকরের গলার কিংবদন্তী গান “সিনে মে জ্বলন”  এবং আরো কত কত থেকে যাওয়া গান।সেই গান জিতেছে কত কত পুরস্কার, জিতেছে কোটি কোটি মানুষের মন। আপনাদের মনের গভীরে রাখা, প্রিয় সুরকার জয়দেবের প্রিয় গানগুলোও জানাতে ভুলবেন না।

অদৃষ্টপুরুষ কখন কেমন সব দান দিয়ে রাখেন পাশায়! সুদূর নাইরোবিতে জন্ম নিয়ে ভারতবর্ষের মত দেশের সংগীতে, এক ইতিহাস লিখেছিলেন জয়দেব, এমনই সব কাজ করে গেলেন যে আজ সুরকারের জন্মদিনের একশ তিন বছর পরেও বলতে ইচ্ছে হয় – “অভি তো কুছ কাহা নেহি, অভি তো কুছ শুনা নেহি…অভি না যাও ছোড় কর, কে দিল অভি ভরা নেহি”।

Jaydev
jaydev

ছবি সৌজন্যঃ গুগল।

Share this article

Recent posts

Popular categories

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Recent comments