এমনিতে ছুটির দিন সকালে কাজ না থাকলে আমায় ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি ওঠায় কার সাধ্যি। কিন্তু বেড়াতে গেলেই চরৈবেতি।আগের দিন রোমে এসে পৌঁছে যা রোমিং হল সে তো বললাম আগের পর্বেই, তারপরেও পরেরদিন খুব সক্কাল সক্কাল উঠে তৈরী হয়ে নিলাম। কত কি দেখার প্ল্যান আজ!
বাঙালী বেড়াতে গিয়ে কিন্তু পুরো সাহেব, হেভি ব্রেকফাস্ট খাবেই খাবে। আপনি দীপুদা অর্থাৎ দীঘা পুরী দার্জিলিং দাদা হলে তো কথাই নেই, জলখাবারে লুচি তরকারী বা ব্রেড যাই খান না কেন, ব্রেকফাস্ট আরো হেভি করতে পাতে ডিম নেবেন তো বটেই। যাক গে এ তো রোম, নির্ঘাৎ আবার সস্তা পাস্তা সাঁটাতে হবে ভাবছিলাম। তাতে চাপ নেই, তবে নীচে নেমে ওই টার্মিনি চত্বরে ঢুকেই দেখতে পেলাম এক বাংলাদেশী ভাইয়ের খাবারের দোকানে। ওনাদের উষ্ণ আপ্যায়নে, গরম গরম রুটি, আলু ভাজি, ডিমের অমলেট আর গরম দুধ চা দিয়েই ব্রাঞ্চ সেরে নিলাম। মেট্রো ধরে এরপর সোজা কলোসিওর সামনে গিয়ে পৌঁছলাম প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ।
এসব জায়গায় যত তাড়াতাড়ি পারুন পৌঁছে যান, যদি না পাড়ার রেশন দোকানের মত লাইন দিতে চান। নভেম্বরে অপেক্ষাকৃত ভীড় কম, এবং সকাল সকাল পৌঁছনোর ফলে জনা দশেকের বেশী মানুষ সামনে নেই। এটা অবশ্য ভেতরে ঢোকার লাইন। টিকিটের লাইন অপেক্ষাকৃত লম্বা। আমরা আগে থেকেই অনলাইনে পাস কিনে রেখেছিলাম। এই ডে পাসে কলোসিয়মের আর রোমান ফোরাম অন্তর্ভুক্ত। এবং সবচেয়ে স্বস্তি হল লাইনে দাঁড়াতে হল না। এটা ছিল নভেম্বর মাস, তাই নিয়ম অনুসারে ঠিক সাড়ে নটায় আমরা কলোসিয়মে ঢুকতে পারলাম। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলের মধ্যে, উঁচু আর অপ্রশস্ত সিঁড়ি দিয়ে আমরা একেবারে পাড়ি দিলাম হাজার হাজার বছর আগে। সিঁড়ির অংশগুলোয় তুলনামূলক ভাবে আলো অনেকই কম। সুতরাং চালসে থাকুক না থাকুক টর্চ সঙ্গে রাখা বাঞ্ছনীয়। হ্যাঁ, ফোনের টর্চই যথেষ্ট। কাছে রাখুন।
কলোসিয়ম ভ্রমণের স্মৃতি সবচেয়ে বেশী আকর্ষনীয় করে তুলেছিল আমাদের অডিও গাইড। ওখানে টিকিট কাউন্টারেও পাওয়া যায়। ছোট্ট একটা ডিভাইস আর হেড ফোন পাবেন, আরা পাবেন অসামণ্য ইতিহাসের ধারাভাষ্যের পশ্চাৎপটে কলোসিয়ামকে একদম সামনে থেকে ছুঁয়ে দেখার অভিজ্ঞতা।
অডিও গাইডের নিখুঁত এবং ছবির মত বিবরণে মনে হল যেন চাক্ষুষ করছি হাজার হাজার বছর আগের বসে থাকা, সমাজের নানা স্তরের, নারী পুরুষ দর্শকদের। তাদের প্রমোদোল্লাসের মত্ততার আওয়াজ ভেসে আসছে বুঝি। চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছি জীবনের বাজি ধরা, সেইসব অদম্য সাহসী আর অসহায় গ্ল্যডিয়েটরদের। অদ্ভুত একটা ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে আরো অনেকটা সময় কাটালাম। দেখলাম সময়ের সাথে সাথে কিভাবে রোদে পুড়ে( আগুনেও ), জলে ভিজে, ভূমিকম্পও হজম করে, রূপকথার মত দাঁড়িয়ে থেকেছে এই কলোসিয়াম।
ভাষাপ্রয়োগ তো কিছুটা অভ্যাস, তাই অনেক সময় অনেক কিছু বলে ফেলি, উপমা দিয়ে ফেলি অভ্যাসের বশে, কিন্তু ভাবা হয়ে ওঠেনা আর যে কি বলছি।ওই দিন থেকে অমানুষ কথাটা আর নঞার্থক ভাবে ব্যবহার করিনি। মানুষেরাই মনে হয় পারে নিজেদের প্রমোদের জন্য অন্য কারুর জীবন মৃত্যুর খেলা দেখে আনন্দ পেতে।
হেডফোনে গাইড বলে দিচ্ছে এই এইখানে দাঁড়িয়ে বাঁচার লড়াই চালাতে হত গ্ল্যাডিয়েটর দের। এখান থেকে পাঠান হত একের পর এক প্রতিদ্বন্দ্বীদের। এক এক বার করে জিততে হত সেইসব প্রাণের জন্য লড়ে যাওয়া ক্রীতদাসদের, আর তারপর আবার অতর্কিতে এসে পড়তো কখনো আরেক ক্রীতদাস, কখনো বা বুনো শুয়োর, জলহস্তী, জিরাফ, হাতি, বাঘ এবং অবশ্যই সিংহের আক্রমণ। সমস্ত পশুদেরকেই লড়াইয়ের আগে ক্ষুধার্ত রাখা হত দীর্ঘ সময়ের জন্য। কি যন্ত্রণায় কাটতো এই মানুষগুলোর জীবন, যে মুক্তির আশায় তারা মৃত্যুর তোয়াক্কা না করে জীবনের জন্য এই লড়াইকে শ্রেয় বলে মনে করতেন।

কলোসিয়মের আয়তন সুবিশাল।তবে ট্যাঁকের জোর বলে দিত আপনি কোন সিট পাবেন। বিত্তবিচার করে সামনে, মাঝে কি পিছনে মানে উঁচু জায়গায় বসার ব্যাবস্থা ছিল।বিত্ততমরা একদম সামনে বসতো, এবং একদম সামনে থেকে রক্ত দেখার আমোদে ডুব দিত।
ছবিতে কলোসিয়মসহ রোমকে ধরা হয়েছে বহুবার। রোম দেখারও আগে নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটিন মিউজিয়াম অফ আর্টে পাওলো পানিনির আঁকা রোমের বিশাল ছবি দেখে থমকে গেছিলাম। পরে আরো অনেক জায়গায় কলোসিয়মের পেইন্টিং আরো অনেক গল্প শুনিয়েছে। সজ্ঞানে হয়েত অত অপকর্ম করা যেত না, ছবিতে তাই বার বার করে ধরা পরে দর্শকদের মদমত্ততা, (সঙ্গে করে পরিচারক যেতেন, বাবুদের খানা পিনা জুগিয়ে দিতেন) প্রকাশ্যে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া নারীদের প্রতি অযথাযথ আচরণ- এসবই উঁকি দেয় সেই সব আয়নার মত শিল্পকর্মে।
কলোসিয়ম তৈরী হওয়ার প্রায় চার শতক পরে এই বর্বর প্রথা বন্ধ হয়। এক সুবুদ্ধিসম্পন্ন সন্ত, সেন্ট টেলিমুসুয়াস, (উচ্চারণ ভুল হতে পারে, ক্ষমা করবেন) প্রতিবাদ জানান, সম্ভবত এর জন্য তাঁকে বলি দিতে হয় নিজের প্রাণ। তারপর তৎকালীন রাজা হনরিয়াসের হস্তক্ষেপে বন্ধ হয় গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধ। ইতিহাস অবশ্যই তর্ক সাপেক্ষ।
এরপর আরো প্রায় পনেরশ বছর ধরে কলোসিয়ম পরিণত হয়, কখনো ধর্মকেন্দ্র আবার কখনো কর্মসংস্থানের কেন্দ্র আবার একটা সময় শুধুই এক সুন্দর সহজাত বাগানে। অদ্ভুত ভাবে সেখানে শুধু ইতালি নয় সারা পৃথিবীর নানা রকম গাছ গাছালি জন্ম নেয় সেই সময়। তার ইতিহাসটাও অদ্ভুত মজার, কিন্তু অত লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে তাই ক্ষান্ত দিলাম।
ঘোরের মধ্যেই অতি সামান্য লাঞ্চ খেয়ে, রাস্তা পেড়িয়ে একটু হেঁটেই আমরা ঢুকে পড়লাম আর এক ঐতিহাসিক জায়গায়। রোমান ফোরাম। খুব সহজে রোমান ফোরাম কি তা বোঝাতে গেলে খাঁটি বাংলায় বলতে হয় সিটি সেন্টার। রোমানদের ইতিহাস তো আর এক দিনের নয়। অনেক ইতিহাস, কয়েক হাজার বছর ধরে হেঁটেছে এই রোমান ফোরামের রাস্তার ওপর দিয়ে। কোর্ট, আলোচনা সভা, ধর্মস্থান, বাজার, খেলার মাঠ, এমনকি আবারো সেই গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধের জায়গা কি নেই সেখানে। কয়েক হাজার বছর আগের একটা আস্ত শহর দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে।

অডিও গাইড কখনো দেখাচ্ছে আর্চ অফ টাইটাস, আর্চ অফ সেপ্টিমিয়াস সেভেরাস, টেম্পল অফ ক্যাসটর, আবার কখনো দেখাচ্ছে টেম্পল অফ স্যাটার্ন, এর বাংলা অনুবাদ শনিমন্দির করবেন কিনা আপনারাই ঠিক করুন। অবাক হয়ে হাঁটছি আর দেখছি, এরই মধ্যে অডিও গাইড বন্ধু বলে উঠলো, হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, এই তো এখান দিয়েই হেঁটে যেতেন সিজার। মনে হল যেন শিঙা বেজে উঠলো, পাশ দিয়ে সত্যিই হেঁটে চলেছে স্বয়ং ইতিহাস। সন্ধ্যা হয়ে এল। তবু খেদিয়ে না দেওয়া অবধি ঘুরতে থাকলাম দুজনে, প্রাণভরে ছবি তুলে রাখলাম মনের ভেতর, ক্ষয়ে যাওয়া সময়ের এইসব রেলিকগুলোর।
এবার ফিরতে হবে হোটেলের দিকে। রাতের খাবার শেষ করলাম বাইরেই। আর জোগাড় করে রাখলাম কালকের বাসের টাইম টেবিল। কাল যাওয়া হবে ভ্যাটিকন সিটি, সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা, দেখবো সিস্টিন চ্যাপেল। আজ রাতে মনে হয় আর ঘুম হবেনা।
ক্রমশঃ

[…] লন্ডন থেকে ভোররাতে রোম যাত্রার আর সারাদিন ধরে কলোসিয়াম আর রোমান ফোরামে টৈ টৈ করে […]