পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট দেশ ভ্যাটিকান সিটিতে একদিন, বাঙালীর রোমান হলিডে পর্ব ৩

-

আগের দুই  পর্বে গল্প হল আমাদের লন্ডন থেকে ভোররাতে রোম যাত্রার আর সারাদিন ধরে কলোসিয়াম আর রোমান ফোরামে টৈ টৈ করে বেড়ানোর গল্প। তবে দ্বিতীয় পর্বে একটা গল্প জুড়তে ভুলে গেছি। বর্ষাকাল, বাজারে স্যানিটাইজড ব্রাম্ভী শাকের অভাব কিনা তাই স্মৃতিরা ঘুমিয়ে পড়ছে।ঘটনা হচ্ছে আগের দিন সকাল নটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা অবধি হেঁটেও, মানে মাঝের হালকা খাবার খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া, দেখা গেল আমাদের বেড়ানোর উৎসাহে এতটুকু ভাঁটা পড়েনি। ঠিকই ছিল পরের দিন ভ্যাটিকান সিটি যাব, তবু ওই সন্ধ্যে বেলাতেই যেই দেখলাম টার্মিনি স্টপেজ থেকে বাস ছাড়ছে ভ্যাটিকানের উদ্দেশ্যে, আমরা সামান্য চোখ চাওয়াচাওয়ি করেই একে ওপরের মতলব বুঝে ফেললাম, এবং ফুরুৎ  করে সেঁটে গেলাম বাসের ভিতরে। এই বাসও ওই উইকলি পাসেই চড়া যাবে।

এখানে একটু বলে রাখা ভালো, আমাদের যাবার আগে সবাই পই পই করে বলে দিয়েছিল ইতালিতে সাবধান, বিশেষ করে পাসপোর্ট সামহালকে। তাই সব জায়গাতেই টাকা পয়সা এবং পাসপোর্ট ইত্যাদি অতিরিক্ত সজাগ হয়ে আগলাতে হয়েছে। যাই হোক বাসে করে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার কাছাকাছি নামলাম। সময় লাগলো মিনিট কুড়ি মতন। সন্ধ্যের আলোতে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার রূপ দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পাথুরে রাস্তার ওপর দিয়ে আবারো যেন হেঁটে গেলাম কত হাজার হাজার বছর আগে।

সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে ঘুরলাম কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে। ব্যাসিলিকা ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। বাইরে থেকেই দেখছি বিশাল ওবেলিক্স, সেই মিশর থেকে এনে স্থাপন করেছিল সেই রাজা ক্যালিগুলা। । আলোগুলোও কেমন আলো আঁধারি, উস্কে দিচ্ছে আরো কত রহস্য। ব্যাসিলিকার চারপাশের সমস্ত  বড় বড় থামের মাঝ খান থেকে অন্ধকার ছিঁড়ে আলো এসে পড়ছে চত্বরের মাঝে, আর ব্যাসিলিকার ওপরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে কত কত সন্তদের মূর্তি, তারা যে নেই, ওগুলো যে শুধুই শ্বেত পাথরের মূর্তি, সত্যি সত্যি মানুষগুলো যে দাঁড়িয়ে নেই, তা মানতেই চাইছিল না মন। এতটাই প্রাণবন্ত তাদের শরীরের ভঙ্গি, আর তাদের চোখের চাউনি। অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। আরো বেশী সময় ধরে তাদের সাথে সময় কাটাবো কাল এই ভাবতে ভাবতে রাতের শেষ বাসে করে ফিরে এলাম টার্মিনি চত্বরে। তারপর আবার কিঞ্চিৎ ডিনার সেরে হোটেলে ফিরে গেলাম।

রাতের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা

পরের দিন সকালে আবার রুটি তরকারী ডিম ভাজা আর পুরু সরের দুধ চা দিয়েই সারলাম ব্রেকফাস্ট। এদেশে এতবার বেড়াতে গিয়ে কোথাও জলখাবারে রুটি খেয়েছি বলে মনে পড়েনা, হয় লুচি, নয়েত ডিম পাঁউরুটি কিম্বা উত্তর ভারত বা বাংলা হলে আলুর পরোটা। তবে ভারতবর্ষ থেকে অত হাজার কিলোমিটার দূরে বসে, বাংলাদেশী দাদার আপ্যায়নে, অত সুস্বাদু দেশী খাবার খাওয়ার একটা আলাদা মজা আছে। দীর্ঘ দিন প্রবাসে থাকলে এই মজাটা আরো টের পাওয়া যায়।

জলখাবার খেয়ে বাস ধরলাম আগের দিনের মত। শনিবার,তবু সকাল বলে হয়েত বেশ ফাঁকা। আবার পৌঁছে গেলাম আগের দিনের মত সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারের সামনে। সকালে যেন অন্য রূপ। উজাড় করে সূর্যের আলো পড়েছে প্রাসাদোপম ব্যাসিলিকার গায়ে, সেইসব অসামান্য ভাস্কর্যগুলোর গায়ে, প্রাচীন মিশরীয় অবেলিক্সের গায়ে, আর দুধ সাদা, বিশাল বিশাল থাম গুলোর ওপর। আগের দিনের রাত্রের রহস্যের জাল সরে গেছে, দিনের আলোয় অন্যরকম মুগ্ধতা ঘিরে ধরেছে।

সেন্ট পিয়াতার্স স্কোয়ার

বার্নিনি বা মাইকেলেঞ্জেলোর গল্প শুনেছি, পড়েছি রেনেসাঁর ইতিহাসে। তাদের কাজ চোখের সামনে দেখার অভিজ্ঞতা ঠিক লিখে বোঝানো যায় না। ছবি দেখেও কিছুটা টের পাওয়া যায়। তবে ওখানে দাঁড়ালে সত্যি  টের পাওয়া যায় টাইম ট্রাভেল আসলে কি। সময় ধরে অডিও গাইড নিয়ে আস্তে আস্তে বাইরেটা ঘুরলাম। শুনলাম সেন্ট পিটারের গল্প, ধর্মের প্রচারের জন্য তাঁর বলিদানের গল্প। আস্তে আস্তে ঢুকে গেলাম ব্যাসিলিকার ভেতরে।

ব্যাসিলিকার ভেতরের নৈশব্দ, বিশাল উঁচু ছাদ, মাথার ওপরের সেই ঐতিহাসিক ডোম, ফ্রেস্কো, কাঁচের বিশাল বিশাল জানালা, তাদের ওপরের গ্লাস পেইন্টিং সবই  দেখছি, দেখছি অবিনশ্বরের উপাসনার জায়গায় নশ্বরের আঁকা ছবি, গুলিয়ে যাচ্ছে হিসাব, ধর্মের গল্প দিয়ে আঁকা যিশুর প্রতিকৃতি দেখছি আর ভাবছি যে কে ঈশ্বর আর কে তার সৃষ্টি। তবে ব্যাসিলিকার স্মৃতির মধ্যে সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে সেই প্রথম আলো। ওপরের ডোমের কাঁচের ভিতর থেকে অদ্ভুত ভাবে সেই আলো এসে পড়ে ব্যাসিলিকার ভেতর। কনফেশন কি জানিনা। তবে ওই আলো যেন ধুয়ে দিয়ে যায় বাইরের ভেতরের সব অন্ধকার।  

প্রথম আলো

এরপর সেই মুহুর্ত।আরেকজন  আমাদেরই মত হিউম্যান স্পিসিজের এক শিল্পীর সাথে দেখা হল। তিনি তো চলে গেছেন অন্য কোন পৃথিবীতে বহু বছর আগে, তবু দেখা হল, কারণ রয়ে গেছে তাঁর কাজ। গড়ে রেখে গেছেন এই মূর্তি। এক মা তাঁর মৃত সন্তানের শরীর আগলে বসে রয়েছেন, সব অভিব্যাক্তি সেই মায়ের চোখে, সেই চোখ কাঁদেনা, কাঁদায়। বহুক্ষণ দুজনে দাঁড়িয়ে রইলাম, মাইকেঞ্জেলোর পিয়েতার সামনে।

মাইকেলেঞ্জেলোর পিয়েতা

ব্যাসিলিকা থেকে বেড়িয়ে লাঞ্চ সেরে যাওয়ার কথা পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট দেশ ভ্যাটিকান সিটির মিউজিয়ামে। তবে রোমের ব্যাসিলিকার অসামান্য ঘোর ভাঙলো এক মোবাইলফোনের রিং টোনে। যে কেউ বলতে পারে এ ফোন চায়না মেড। নাহলে লাউড স্পিকারের অত তেজ আর কোথাও পাওয়া যাবে কি? ব্যাসিলিকার বাইরের  সব নৈশব্দ  গ্রাস করে ভেসে এল সুর “ইস্টিশানের রেলগাড়িটা, মাইপ্যা চলে ঘড়ির কাঁটা” – আগুণ আগুণ পুরো। জিও বাঙালী জিও। দৌড় দিয়ে স্যান্ডুইচ কফি খেয়ে ছুটলাম ভ্যাটিকানের বিশাল পাঁচিলকে বাঁহাতে রেখে।মিউজিয়মে ঢোকার লম্বা লাইনে দাঁড়াতেই হল।

আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় আমার কয়েক হাজার বছর বয়েস। মিউজিয়ামে গেলে বাপের বাড়ি ফেরার মত আনন্দ হতে থাকে। কত ঘণ্টা পার করে, হাঁ করে দেখতে দেখতে আজ অব্ধি দেশে বিদেশের একটা মিউজিয়ামও দেখে আশ মিটেছে এমন হয়েনি, বরং আফসোস হয়েছে। বিশাল ভ্যাটিকান মিউজিয়ামে প্রথমেই আটকে গেলাম এর কোর্টিয়ার্ডে। এক নদীর দেবতা, মা গঙ্গার কাজিন হলেও হতে পারেন, কি যে অপূর্ব তার রূপ, থমকে গেলাম সেই শ্বেত পাথরের মূর্তির সামনে।

গড অফ রিভার

এরপর এক এক করে ঘুরতে লাগলাম, দেওয়ালে সব অসামান্য চিত্রশিল্প, ওপরে ফ্রেসকো, তারি মধ্যে কখনো গ্রীক, রোমান, ইজিপ্সিয়ান শিল্পের সমাহার, আবার দেখছি ভ্যাটিকানের বিশাল লাইব্রেরী, দেখা মানে শুধুই আয়তনটুকু, দেখলাম বাইরের সাজানো বাগান। ওদিকে তো আবার মাইপ্যা চলতে হচ্ছে ঘড়ির কাঁটা। সব প্রলোভন ছেড়ে ঢুকে পড়লাম সেই ওয়ান্ডার ওয়ার্ল্ডে।

আমরা যখন লন্ডনে, তখন এক সপ্তমীর রাতে, এক বারে বসে বাজেট করে ঠিক করেছিলাম, ইউরোপ এবং ইউ কে মিলিয়ে এই যাত্রায় আরো দুটো দেশ দেখতে পারবো। ফ্রান্সের প্যারিস তার মধ্যে অবশ্যই একটা। আর হয়েত স্কটল্যান্ড যাওয়া হবে ক্যাসল দেখার লোভে। সেদিন চারপাশের হাওয়ায় কিছু একটা ছিল। বায়না যার ধাতে নেই, সেই মহীয়সী আমি, মৌতাতে বলে উঠলাম, রোম যাওয়া যায়? সিস্টিন চ্যাপেল দেখা যায়? পাশের জনও নিঃসন্দেহে মৌতাতেই ছিলেন, সেই দিনই সব প্ল্যান হয়ে গেল আরো এক স্বপ্ন সত্যি করার।

সেই সিস্টিন চ্যাপেলে ঢুকছি আমরা। ঢোকার অংশটুকুতে একটু অন্ধকার ঠেলতে হয় কিন্তু তারপরে যে আলো ঘিরে রয়েছে সেখানে, সেটা ওখানে গিয়ে, ওই ছাদের তলায় না দাঁড়ালে টের পেতাম না।বিশাল যে পরিসর ওই চ্যাপেলের তা কিন্তু নয়, তবে সারা হলের মেঝে টুকু ছাড়া সব জায়গা জুড়ে রয়েছে ছবি, ইতিহাস, ধর্ম, গল্প, পুরাণ, রহস্য, বার্তা। ওখানকার প্রতি নিঃশ্বাসে জুড়ে রয়েছে রেনেসাঁ। মাথা হেঁট হচ্ছেনা কারুর, অবাক বিস্ময়ে সবাই দেখছি সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিং।

মাইকেলেঞ্জেলো কিভাবে পেরেছিলেন, এমন করে ভাবতে, কি ভাবে প্রায় ঝুলে ঝুলে এঁকেছিলেন ইতিহাস, এতগুলো বছর ধরে। ক্রিয়েশন অফ অ্যাডামস আঁকার সময় কখনো কি তাঁর মনে হয়েছিল, একদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘাড় উঁচু করে এই শিল্পকর্ম দেখবেন আর মনে মনে ঈশ্বর জ্ঞানে তাঁকেই ছুতে চাইবেন।

সিস্টিন চ্যাপেলে ছবি তোলা বারণ। সিকুউরিটির লোকেরা বারবার সম্বিৎ ফিরিয়ে দেন অবাধ্য ভিজিটরদের বকা ঝকা দিয়ে। যাকগে, জানেন কি ভাটিক্যানের কিছু সিকিউরিটি গার্ড কিন্তু এখনো ডিজাইনার পোশাক পরেন, সেই ডিজাইনও করেছিলেন স্বয়ং  মাইকেলেঞ্জেলো।

 সিস্টিন চ্যাপেলের দেওয়ালেও কিন্তু শিল্পকর্ম দেখার মত, তবে মাইকেলেঞ্জেলো দেখার পর মাথা ঝিমঝিম করে কিছুক্ষণ।ঘোর থেকে যায়। সত্যিই এই দিনটা আমাদের এই  জীবনে ভোলার কথা নয়, একদিনে পিয়েতা আর সিস্টিন চ্যাপেল, বার্নিনির  স্থাপত্য, বত্তিচেল্লির ছবি – কোন রূপকথার চেয়ে কম বলুন। এর পর  সেদিন কি করেছিলেন, কি খেয়েছিলাম সেসব কিছু মনে নেই, শুধু মনে আছে দুজনেই অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারিনি। ফিরে এসে সেন্ট এঞ্জেলোর ব্রিজ থেকে তাকিয়ে ছিলাম রূপসী ভ্যাটিকানের দিকে। দূরে তারযন্ত্র বাজিয়ে কেউ একজন গান গাইছিল। সে সুরের ভাষা জানিনা। তবে নদীর পারে গাইছিল বলেই কি বিচ্ছেদী ভাটিয়ালীর সুর মনে পড়ছিল। রোমে আমাদের আর দুদিন। কাল শুধু শহরটা ঘুরবো, যেখানে পুরনো আর নতুন ওই গড আর অ্যাডামের মত হাত মেলাতে চায়, পরশুর জন্য অপেক্ষায় আছে রোমের থেকে কয়েক স্টেশন দূরে, প্রাচীন শহর অস্টিয়া অ্যান্টিকা।

ক্রমশঃ

ফ্রেসকো

Share this article

Recent posts

Popular categories

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Recent comments