বাঙালীর মনে সবচেয়ে বেশী পুলক জাগায় কোন ফিলিংস দাদা? আরে জানো না, সবার সেরা ফিলিংস হল পুজো আসছে আসছে। এপ্রিল থেকে মাঠে, গড়িয়াহাটে, স্থলে জলে মলে ঢাক বাজছে, জুন থেকে পুজাবার্ষিকী ছাপছে, বাঙালীর আগস্ট থেকে মেট্রোতে মহিষাসুরমর্দিনী, আর অষ্টমীর দুপুর থেকেই সুপার কাঁদুনী। পুজোর পরে বাঙালীর এই গ্রেট ডিপ্রেশন কিছুটা মুছিয়ে দেন মা লক্ষ্মী, মা কালী আর যম ও যমুনার মন্ত্র বলা ভাইফোঁটা, কিন্তু তারপর? সব দিনই সোমবার।কাজেকম্মে মন নেই, অফিসে বসের মুখ মনে করে কাঁদুনী, বাড়িতে আবার ডাল ভাত তরকারী দেখে পুজোর এগ রোল চাউমিন মনে করে কাঁদুনী, আর সুপ্রিম কাঁদুনী জাগছে সোশ্যাল মিডিয়ায় মহা ভাগ্যবান বন্ধুদের বেড়ানোর ছবি দেখে। হ্যাঁ, এই ডিপ্রেশনের নেশামুক্তির একটাই উপায় বাঙালীর হাতে,বেড়িয়ে পরা, আর না বেড়োতে পারলে বেড়ানোর গল্প পরা।
আজ পুজোর পরেরই একটা দিন ঠিকই, তবে রোমে আজ শরৎ নয়, বরং হেমন্ত জাগ্রত দ্বারে। কলোসিয়াম, রোমান ফোরাম, ভ্যাটিকান সিটি ঘুরেছি প্রাণভরে। তবে আজ কোন প্ল্যান নেই, কোন লিস্ট নেই, আজ আমাদের হারিয়ে যাওয়ার দিন। আর কি, সকালে রেডি হয়ে, উইকলি পাস ব্যাগে নিয়ে শুরু হল রোমে ফ্রী রোমিং। অবশ্য রোমান্সিংও বটে।
উইকলি পাশে বাসে চড়ে প্রথম গিয়ে দাঁড়ালাম আমাদের আজকের প্রথম স্টপ প্যান্থিয়নে। অনেকেই এই গল্প শুনে বলে প্যান্থিয়ন তো প্যারিসে, আলবাৎ, প্যারিসে তো আছেই, কিন্তু রোমেরও রয়েছে প্রাচীন মন্দির প্যান্থিয়ন। আবার ফিরে গেলাম পুরোনো দিনে। গুগলে একগাদা ছবি আছে, তবে এক একটা টুকরো স্মৃতি থাকে না, যা কয়েক মিনিটের বেশী জীবনে ঘটেনি কিন্তু মনে থেকে গেছে অনেক বছর ধরে। প্যান্থিয়নের থেকে বেশী করে মনে থেকে গেছে প্যান্থিয়নের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ঘোড়ার গাড়ির ছবি। বাইরে অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছে তখন, তাই ঘোড়া বাবু দেখলাম গায়ে বর্ষাতি চাপিয়েছেন। খালি গাড়ি, খোলা গাড়ি, দেখে মনে হচ্ছে কয়েকশ বছর আগে কাউকে বেড়াতে নিয়ে এসেছিল, সে আর ফিরে আসেনি বিশাল প্যান্থিয়নের ভেতর থেকে, গাড়ীটা এখনো সেই মনিবের অপেক্ষায়। অতশত না বুঝে খালি গাড়ি পেয়ে এই সময়ের এক সওয়ারী উঠে পড়ে গাড়িতে, কিন্তু ঘোড়াটা সেখান থেকে যেতে নারাজ। কত ছবি তৈরী হয়, সেরকম কিছু ছবি আর মুছে যায় না।

অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে শুরু করি। ক্লান্ত লাগে, বাসে উঠে পড়ি। তেমাথার মত একটা মোড়, সেখানে দেখি আবার এক বিশাল সাদা পাথরের ইমারৎ, এই রোকো, বাস থামাও, নামবো আমরা। দৌড়ে নামলাম, বাস চলে গেল। রাস্তা পেড়িয়ে দাঁড়ালাম ভিত্তরিয়ানোর সামনে। ভিক্টর ইম্যানুয়েল ন্যাশানাল মনুমেন্ট। রোমের এখনো অবধি দেখা স্থাপত্য দের তুলনায় ইনি প্রায় হাঁটুর বয়েসী। কিছুক্ষণ ঘুরে, বাইরের এবং ভিতরের সিঁড়ি পেরিয়ে পৌঁছে যাই ছাদের ওপরের ওপেন এয়ার ক্যাফে তে। সুদৃশ্য পাত্রে গরম কফি এল। ছাদের ওপর থেকে রোম শহরকে নতুন করে দেখলাম।দেখলাম আসে পাশের বাড়িঘর, তাদের টব বারান্দার বাগান, ছাদে শুকোতে দেওয়া জামাকাপড়, একরকম করে ছাঁটা রাস্তার দুপাশের গাছ আর স্বল্প বৃষ্টিস্নাত বর্তমানের রোম।

ক্যাফের নরম বাজনা ছাপিয়ে বিকট চিৎকার শোনা গেল, দেখি আমাদের প্রায় কাছ ঘেঁসে এক জোড়া সিগাল অ্যাঙ্গরী বার্ডের মত মুখ করে এসে বসেছে। গলার কি দাপট দুটোর! তবে ওদের দেখেই হঠাৎ করে সমুদ্রের জন্য মন কেমন করে উঠলো।
আস্তে আস্তে তখন বিকেল নামছে রোমে, অলি গলি রাজপথে ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পৌঁছোলাম সেই বিখ্যাত স্প্যানিশ স্টেপসে।তবে রোমান হলিডেতে দেখা ছবির চেয়েও ভালো লেগে গেল আসল জায়গাটা। অত চওড়া সিঁড়ি, লোকজন বসে আছে, গল্প করছে, গান গাইছে, ছবি তুলছে, আবার সেই সিঁড়িরই মাঝে এক চিলতে করে ফুলের কেয়ারী। আমরা থাকলাম কিছুটা সময়ে, আমাদেরও স্মৃতি তৈরী হল।
আবার চললাম, এবার অবশ্য একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু, আহা, পথের পাশে এসব কিসের স্বর্গীয় খাবারের দোকান? কত কত ফ্লেভারের জিলাটো, আহা খেতেই হবে। মাত্র নবছর আগের কথা, কিন্তু তখনো কলকাতার মলে মলে এই জিনিস পাওয়া যেত না। আয়েস করে খেতে খেতেই চলে এলাম আবার পুরোন সময়ে। হাতে জিলাটো, চোখের সামনে ট্রেভি ফাউন্টেন, স্বর্গসুখও এর চেয়ে বেশী কিছু হতে পারেনা। কি অপূর্ব সব মূর্তি, কি নিখুঁত পাথরের কাজ! আমাদের এখানে গঙ্গার জলে পয়সা ফেলার একটা মজার ব্যাপার হয়, আমেরিকাতেও প্রচুর উইশিং হোয়েলের গল্প আছে দেখেছি, তবে ট্রেভিতে প্রায় সব লোককেই দেখলাম, উল্টোদিকে তাকিয়ে জলে পয়সা ফেলছে, এতে নাকি মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। ট্রেভি ফাউন্টেনের সামনে থেকে উঠতেই ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু রাত হয়েছে, আমরা সেই সকালে বেড়িয়েছে, কাল আরো সকালে বেড়োনো, তাই ইচ্ছে না থাকলেও, আজকের দিনটাকে ছুটি দিতেই হল।

প্রথম পর্বেই বলেছিলাম, আমাদের কিসব দারুণ প্ল্যানিং এর গল্প, যা আমরা যেকোনো বেড়ানোর আগে থেকে করে থাকি। রোম ভ্রমণের শেষ দিনটা আমাদের সাজানো ছিল অস্টিয়া অ্যান্টিকা যাওয়ার জন্য। অনেক আগে থেকেই অস্টিয়া অ্যান্টিকা যাওয়ার স্বপ্ন ছিল। যেমন এখনো স্বপ্ন আছে একদিন এই ইতালিরই পম্পেই শহরের ধ্বংসস্তুপ দেখার। তেমনি ইচ্ছে ছিল রোমের খুব কাছে এই অস্টিয়া অ্যান্টিকা যাওয়ার। এই অস্টিয়া অ্যান্টিকা ছিল ওই সময়ের প্রাচীন বন্দর। রোমের ব্যাবসা বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল এই নগর। আর অস্টিয়া অ্যান্টিকা যাওয়ার ইচ্ছে দ্বিগুণ হয়ে গেছিল যখন পড়লাম যে ওখানকার রুইন্সগুলো এরা কিভাবে যত্ন নিয়ে সংরক্ষণ করে রাখতে পেরেছে। প্রাচীন পম্পেই এর বেশীরভাগ জায়গাই নাকি এখন নেই হয়ে গেছে, কিন্তু অস্টিয়া অ্যান্টিকায় এখনো পুরনো নগর এবং বন্দরের প্রায় অটুট ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়।
রোম থেকে ট্রেনে চড়ে যাত্রা শুরু হল, কিছুক্ষণের মধ্যেই লিডো স্টেশনে পৌঁছে গেলাম, এখান থেকে হেঁটে অস্টিয়া অ্যান্টিকার সাইট। দূর থেকে ইঁটা রঙের স্বপ্নপুরী আমাদের ডাকতে লাগলো। কিন্তু কি নিরিবিলি, সারা পৃথিবী থেকে লোকজন আসে অস্টিয়া অ্যান্টিকা দেখতে, তবে এত ফাঁকা! বেশি সকাল সকাল এসে পরেছি কী। ঠিক তখনই সিকিউরিটি গার্ড দাদার কথায়, মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়লো আমাদের।কার মুখ দেখে উঠেছিলাম কে জানে, আমাদের মতে পৃথিবীর সেরা প্ল্যানার জুটির মুখে বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় এসে পড়লো প্রায়, শুদ্ধ ইংরাজিতে দাদা বললেন, আইজ কি করতে আইসেন আফা, ঝানেন না আইজ সোমবার। অস্টিয়া অ্যান্টিকা সাইট সোমবারে বন্ধ। মনে হচ্ছিল সাইটের ওই লোহার দরজাতেই দুজনে মাথা ঠুকি। এত বড় ক্যাবলামিটা আমরা করলাম কি করে। কিন্তু কিছুই করার নেই, সত্যি সত্যিই দরজার কাছ থেকে আমাদের খেদিয়ে দেওয়া হল।

এবার কি? অর্ধেক দিন পড়ে আছে, সেই রাত্রিবেলা লন্ডনে ফেরার ফ্লাইট। এখন ক্যায়া করেগা দিনভর? রোমে ফেরৎ যাওয়াই যায়, কিন্তু মনে পড়লো, কাল সিগালের ডাক শুনেছি, আজ দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর অন্যতম পুরনো বন্দরে, তার মানে সমুদ্র কাছেই আছে। উত্তেজিত হয়ে স্টেশনেই গুগলকে জ্বালাতে শুরু করলাম, তার আগেই স্থানীয় এক আলাপি ভদ্রলোক, ঝুলে যাওয়া মুখের কারণ ঠাহর করে, বুঝিয়ে দিলেন।আর মাত্র দুটো কি তিনটে ষ্টেশন। সেখানে নেবেই হাঁটাপথেই সমুদ্র। অনেক ধন্যবাদ দিয়ে পরের ট্রেনে উঠে চলে এলাম আরেকটা স্টেশনে। তারপর গুগল ম্যাপের পরামর্শে,অলি গলি দিয়ে, প্রায় এর বাড়ির ছাদ, ওর বাড়ির উঠোন পেড়িয়ে দেখা হল তার সাথে। বড় রাস্তার ওপারে, এক্কেবারে খালি বিশাল সি বীচ, আর শুধু আমাদেরই জন্য বিপুল টাইরেনিয়ন বিশাল বিশাল ঢেউ তুলে কাছে ডাকছে।
বাচ্চাদের মত দৌড় লাগালাম। সেদিন বুঝেছিলাম, পৃথিবীর বেশীরভাগ সুন্দরতম মূহুর্ত কপালে জুটে যায় নিজেদের না, অন্য কোন একজনের প্ল্যানে। অনেকটা সময় শুধু দুজনে কাটালাম সমুদ্রের ধারে, পা ভেজালাম জলে, আবার পারে এসে বসলাম। মনে হচ্ছিল, সারা পৃথিবীতে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই সেই মূহুর্তে। হঠাৎ কানে এলো, “ইন্ডিয়া ইন্ডিয়া, না না বাঙালী না, বম্বে থিকা আইসছে মনে হয়”। আরো দুই মক্কেল এতক্ষণে টুরিস্ট দেখে সিবীচে এসে দাঁড়িয়েছেন। হাতে শাঁখের না হলেও, গয়না রয়েছে। কথা হল, লোভে পড়ে একটা সুন্দর বালা কিনে নিলাম চূড়ান্ত দরাদরি করে। মন আরো ভালো হল। আরো কিছুক্ষণ শুধু সমুদ্রের আওয়াজ কানে নিয়ে বসে রইলাম। এবার ফেরার পালা। ট্রেন ধরে রোমের হোটেল, তারপর আবার বাসে করে সেই দা ভিঞ্চি এয়ারপোর্ট, আবার ফ্লাইট, আবার লন্ডন। কিন্তু কিছুটা আমরা আজন্মের জন্য রয়ে গেলাম রোমে, আর অনেকটা রোম থেকে গেল শুধু আমাদের হয়ে।