তখন বাঙালীর ২৫শে বৈশাখের সংজ্ঞা ছিল অন্যরকম। সবাই রাজা সেজে গান গাওয়া গায়ক গায়িকাদের এক পক্ষকাল ব্যাপী ফেসবুক লাইভের ভয়ে কাঁপতো না বাঙালী। বরং মুখিয়ে থাকতো ঐদিন সকালে দূরদর্শনের পর্দায় জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি এবং রবীন্দ্র সদনের অনুষ্ঠানের লাইভ শুনবে বলে। শয়ে শয়ে মানুষ গিয়ে জড়ো হতেন ওই দুই পুন্যভূমে গান শোনার জন্য।সবাই যে খুব গান শুনতেন তা নয়, গান চলাকালীন শিল্পীর শাড়ীর রং, মোটিফ, ব্যাঙ্গালোর না মুর্শিদাবাদী সিল্ক, অতঃকিম বাড়ি গিয়ে কি রান্না করতে হবে এসব অশালীন আলোচনাও চলত, কিন্তু তবু প্রচুর মানুষ যেতেন শুধুই প্রাণভরে গান শোনার জন্য।
২৫শে বৈশাখ ছুটির দিন হলেও সকাল সকাল উঠতে হত, ঘুম ভাঙতো এস্রাজের সুর মেলানোর সুরে। সকালের দিকে আধো ঘুম ঘোরেই বেশীরভাগ গান কানে আসতো।সেই রকমই এক ২৫শে বৈশাখের সকালের সব ঘুম কেটে গেছিল এক পরিবেশনায়। নির্ধারিত সময়ের অনেক বেশীক্ষণ সময় ধরে এস্রাজ বাঁধা হচ্ছে। শিল্পী এসে বসেছেন একটা চেয়ারে, মাটিতে বসতে পারবেন না বুঝতেই পারছি। হাসি হাসি লাবণ্যভরা মুখে সম্রাজ্ঞীর মত বসে রয়েছেন গীতা ঘটক।সুর বাঁধা আর ওনার মনোমত হচ্ছে না, সুর মিলাতে বেশ বেলা গেল, অবশেষে গান শুরু হল। এস্রাজের সাথে মধুর মত মিশে গেল গলা, ষড়জ, ঋষভ মধ্যম পঞ্চম, আবার কোমল নিষাদ কোমল ধৈবত ছুঁয়ে এসে সুর দাঁড়ালো মধ্যমের মীড় চুঁইয়ে কোমল গান্ধারে। উদাত্ত কণ্ঠ কিন্তু কি সুরের দখল, কিভাবে স্বর লাগাচ্ছেন, অবলীলায় আদর করে ছুঁয়ে যাচ্ছেন স্পর্শস্বরদেরও আর গাইছেন “তোমার সুর শুনায়ে যে ঘুম ভাঙাও”। সেদিন যেন নতুন করে শুনলাম গীতা ঘটকের গান আর বাকী জীবনের জন্য মত্ত হয়ে গেলাম।
আমাদের পরিবারে গীতা ঘটকের গান অবশ্য তার আগে বহু দশক ধরে শোনা হচ্ছে। কোন কালে, আমার জন্মের আগে, বাবা মা আড়াই বছরের দিদিকে নিয়ে ম্যাক্লাস্কিগঞ্জ গেছিলেন, সঙ্গে ছিল ছোট্ট টেপ রেকর্ডার, কোন উঁচু ঢিবিতে বসে সেই রেকর্ডারে বাজানো হত গীতা ঘটকের গলায় “আমি যে আর সইতে পারিনে”। পাণ্ডব বর্জিত সেই জঙ্গলে, আছড়ে পড়ছিল ওইসময়ই ওই আপার্থিব সুর। আমি কিন্তু সেখানে যাইনি।কিন্তু ওই ভৈরবী আমার চোখে অমনই একটা ছবি এঁকে দেয় আজও।
গীতা ঘটকের পারিবারিক বনেদীয়ানা কিন্তু কলকাতা এবং লখণৌ এর লোকেদের মুখে মুখে আজও ফেরে।আবার বিবাহ সূত্রেও এমন এক পরিবারে আসেন যা বিশ্ব চলচিত্র জগতের এক পীঠস্থান।অভিনয়ও করেছেন। ঋত্বিক ঘটকের মেঘে ঢাকা তারা ছবিতে, গীতা ঘটকের অভিনয় করা চরিত্রের ওপর কত রাগ করেছি প্রথম প্রথম আমরা সবাই, কিন্তু পরে বুঝেছি অভিনেত্রী হিসাবেও তিনি কতটা সফল। সিনেমাটার কত জায়গায় উনি কত গুনগুন করেছেন।মেঘে ঢাকা তারায় লাগি লগন বা যে রাতে মোর নিয়ে আমরা কত ঝড় তুলি কফির কাপ হাতে, ওই ছোট্ট ছোট্ট সাংগীতিক ডিটেইলস গুলো নিয়ে কিন্তু ভাবা হয়ে ওঠেনা।
কোলকাতা সাগার কাজের সময়ে যখন সৌভাগ্য হয় বিদূষী ঋতা গাঙ্গুলীর সংস্পর্শে আসার, তখনো কি সুন্দর এক স্মৃতিচারণের সাক্ষী হই। বোন এখনো আদুরে, নালিশী স্বরে আশি বছর বয়েসে, দিদির কথায় বলে ওঠেন, “কিচ্ছু প্র্যাক্টিশ করতো না, তবু যেখানেই যেত ফার্স্ট এসে যেত, এমন ভালো গাইত”।
গীতা ঘটকের গান সবার চাইতে আলাদা। শৈলজারঞ্জন মজুমাদারের গায়কী ছাপা ঠিকই, স্বর ক্ষেপণ একই , কিন্তু আলাদা কোথায়। আলাদা, গানটাকে বলার মধ্যে, ওনার অভিনয়ের মধ্যে, নায়কীর মধ্যে। উচ্চারণের, প্রকাশভঙ্গীর স্বতন্ত্রতায়।
প্রতিটা শব্দ বলার পিছনে থাকতো ভাবনা। অথচ কথা সামলাতে গিয়ে সুরের এতটুকু অযত্ন নেই। স্বরগুলো যেন গলাতেই পাকা বাড়ি বানিয়ে থেকে গিয়েছিল বরাবরের মত।
গীতা ঘটকের যে গানগুলো ঘোর লাগিয়ে দেয় তাদের কথা বলতে গেলে বলতে হবে “কে বসিলে আজি হৃদয়াসনে”। অমন টপ্পার দানা, অমন মীড় হয়েত শুনতে পাই, কিন্তু অলংকারদের অলংকার হিসাবে না গেয়ে অভিনয়ের স্বচ্ছ মসলিনে মুড়ে সাজিয়ে তুলতে আর কজন পেরেছেন? “বড় বিস্ময় লাগে”, “হৃদয় আমার প্রকাশ হল”, “আজ জ্যোৎস্না রাতে”, “যে রাতে মোর” এবং এরকম আরো অনেক গান গীতা ঘটকের সাথে মিশে গেছে আজও, অনেক অনেক সুহৃদের কাছে। চলে যাওয়ার এক যুগ পার করে, সুরেরা থেকে গেছে, রয়ে গেছে এস্রাজে মিশে যাওয়া তার সপ্তকের ষড়জ, মনে গেঁথে গেছে
“আছো অন্তরে চিরদিন, তবু কেন কাঁদি ”।
