খুব বেশীদিন নয়, তিন শতকের শহরে, মাত্র তিন দশক আগেও আমরা গান শুনতাম, গান দেখতাম কম।শিল্পীকে না দেখেই তাঁদের গান শুনতাম, আমাদের ছোটোবেলাতেও। গুরুগম্ভীর স্বরে ঘোষকের গলায় রেডিওতে শুনতাম, “এখন শুনবেন পুরাতনী গান, শিল্পী চণ্ডীদাস মাল”। অত ছোটবেলায় তখনো সৌভাগ্য হয়নি শিল্পীর দেখা পাওয়ার। তবু চণ্ডীদাস মাল ছিলেন না জানি কত চেনা। ওনার গান বাজলে রেডিওর ভলিয়্যুম বাড়িয়ে দেওয়া হয়, পড়া বা খেলা ছেড়ে বসতে হয় রেডিওর কাছে এসে, প্রতিবারই স্থানু হয়ে যাই সকলে, প্রতিবারই ওনার প্যান্ডোরার বাক্স থেকে বেড়িয়ে পড়তে থাকে নতুন নতুন গান, পরে বুঝেছি সেই সব গানেদের বয়েস দুশ তিনশ কি তারও বেশী। পুরাতনী গানে, প্রথম জানালা খুলে আকাশ দেখান চণ্ডীদাস মাল।
এর বহু বছর পরের এক শীতের সকাল।রাজ্য সঙ্গীত অ্যাকাডেমিতে চলছে নানা বিষয়ে প্রতিযোগিতা প্রায় পুরো শীতকাল জুড়ে। কীর্তন এবং অতুলপ্রসাদ রজনীকান্তের গান ছাড়াও তৃতীয় বিষয় চয়ন করেছি পুরাতনী গান। কয়েক মাস ধরে রেওয়াজও করে রেখেছি এক বেশ কালোয়াতি গান। রাজ্য সঙ্গীত অ্যাকাডেমির সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে চলেছি কাফি রাগের এক জমজমায় জমানো টপ্পা। হুঁশ বিশেষ ছিল না মনে হয়। শুধু দেখেছিমাল একটা সাদা অ্যামবাস্যাডার গাড়ি থেকে সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পরে একজন নামলেন।
বাবা আমার পাশেই ছিলেন, তিনি খেয়াল করেছিলেন,কয়েক মিনিটের মধ্যে আমায় বললেন দাশু রায়ের একটা বেশ আপাত সরল গানের কথা, জানতে চাইলেন গাইতে পারবো কিনা।
হ্যাঁ বলতে কুণ্ঠা হচ্ছে, তবু হ্যাঁ বললাম কারণ এ বিষয়ে বাবা এতটাই বিচক্ষন যে কিছু বলা চলে না, কিন্তু ভেতর থেকে হাজারো “কিন্তু” উপচে আসছে। কোথায় আমার রেওয়াজ করা টপ্পা আর কোথায় এই গান, কোথায় সিন্ধু কাফি আর কোথায় এই মিশ্র খাম্বাজ, কোথায় যৎ আর কোথায় দাদরা। অস্বস্তি টের পাওয়ায় আমাকে শুধু বলা হল, সব ভুলে ওই গানের ভাবে ডুবে গানটা গাওয়ার কথা।
যথাসময়ে গান গাইলাম, ছোট্ট মত একটা স্টেজে, পাশে এক কাকু তবলা বাজালেন। আর সামনে বসে রয়েছেন স্বয়ং চণ্ডীদাস মাল, যার সাথে পুরাতনী বাংলা গান প্রায় এক নিশ্বাসে উচ্চারণ করা হয়। সঙ্গে রয়েছেন আমাদের ইউনিভার্সিটির আরেকজন অধ্যাপিকা। যার মুখে সবসময়েই দেখেছি উৎসাহ ব্যাঞ্জক মধুর হাসি। কিন্তু সামনে তো বসে রয়েছেন সেই মহীরূহ, মুখে কিন্তু হাসি নেই, যাকে আগে কখনো গান শোনানোর সৌভাগ্য হয়নি, আর হবে না কোনদিন।
মনে তখনো অস্বস্তি কেন নিধুবাবু নয়, কেন এত সহজ গান গাইছি, গুচ্ছ গুচ্ছ রবীন্দ্রভারতী, বিশ্বভারতী, এবং আরো অনেক ছাত্র ছাত্রীরা কত ভালো ভালো কালোয়াতি গান গাইছে আর আমি, যাকগে, গুরুকে স্মরণ করে গান শুরু করলাম, তারপর আর কিছু মনে নেই —
“…অভাজন বলে কি আর, তোমার প্রেমের যোগ্য নই,
ভাবতে যদি সময় গেল, ডাকতে পেলাম কই”
গান শেষ করলাম, চোখ খুলে শুধু দেখতে পেয়েছিলাম, আরো এক জোড়া চোখ এতক্ষণ মুদিত ছিল। আস্তে আস্তে চোখ খুললেন সম্রাট। এরপর বাইরে অপেক্ষা করার পালা। যদি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকাই অনর্থক মনে হচ্ছিল। তবু একবার ওনার পায়ের ধুলো নেব মনে করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার পর রেজাল্টের পালা। সেদিন একেবারে পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আবছা স্বরে বলতে শুনলাম প্রথম স্থানাধিকারী , ধ্যাৎ, এ ইলিউশন, ভুল শুনছি, হতেই পারেনা। তখনো মনে চলছে, জমজমা গাওয়া হয়নি, গিটকিরি দেখানো হয়নি, আজ তো শুধু সমর্পন করেছিলাম। সেই অঞ্জলি তাহলে পৌঁছেছে তাঁর পায়ে। দৌড়ে গিয়ে প্রণাম করেছিলাম, মাথায় শুধু পরম স্নেহে হাত রেখেছিলেন একবার।এঁর সেই স্পর্শটুকু দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, গানটা রাগ নয়, তাল নয়, মীড় নয়, গমক নয়, গানটা শুধুই সমর্পন।
আজকাল বহু শব্দই দেখি বহুল ব্যবহারে লঘু হয়ে চলেছে। যুগাবসান শব্দটাও মনে হয় সেই গোত্রেই সামিল হয়েছে এই সময়ে। একানব্বই বছর বয়েসে, আজ শ্রী চণ্ডীদাস মালের চলে যাওয়া স্বদর্থে এক যুগাবসান।
সময় আর বাংলা গানের ইতিহাস খুব যত্ন করে আগলে রাখা ছিল তাঁর কাছে। বাংলা টপ্পা, শ্যামাসঙ্গীত, আগমনী গান, নাটকের গান, যাত্রার গানেরা বাড়ি বেঁধেছিল চণ্ডীদাস মালের কণ্ঠে। মধ্যযুগের সময় থেকে তৈরী গানেরা ঠাঁই পেয়েছিল এই অনন্য গায়কের সিন্দুকে। সেই সময়ের সাথে আজকের সেতু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। আজ যেন সেই তার ছিঁড়ে গেল। এখন হয়েত অন্য কোন আনন্দলোকে কালীপদ পাঠকদের মত গুরুর সামনে বসে আবার শুরু হবে অন্য কোন তালিম। এই পৃথিবীতে সেই অপার্থিব সুর আর এসে পৌঁছবে না।
