একশ পঁচিশ বছরের জন্মদিনে শ্রী দিলীপ কুমার রায়কে মনে করে

-

বাঙালী মাত্রই তর্কপ্রিয়- এ কথার স্বপক্ষে আজ আর নজির দিতে লাগে কি? সর্বত্রই বাঙালী তর্ক করে চলেছেন, বাঙালী ইসকুল কলেজে শিখেছে ডিবেট ক্লাবে বিপক্ষে বললে বেশী হাততালি, এখনকার ভাষায় বললে বেশি লাইক।সেইজন্য বিপক্ষে চেঁচাতে হয় তাই চেঁচায়, তার জন্য অবিশ্যি আজকাল যুক্তি তর্কের ধার মাড়াতে হয় না বাঙালীদের।  তর্ক করার জন্য তর্ক করা, তাতে সারবত্তা থাকুক বা না থাকুক।

এবার একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক, যখন “তর্কবাগীশ” ছিল উপাধি। প্রচুর পড়াশুনো করে, চেতনার মধ্যে দিয়ে, জ্ঞানের মধ্যে দিয়ে তর্কযুদ্ধে, অকাট্য যুক্তি দিয়ে অপরপক্ষকে বুঝিয়ে বা হারিয়ে, পণ্ডিত তকমা পেতেন মানুষ। তাঁদের ভাবনা তাঁদের জীবদ্দশাতেই দর্শন হয়ে ভাবাতো আর পাঁচটা মানুষকে। না বুঝে মেনে বা মানিয়ে নেওয়া ধাতে সইত না, শিক্ষার পরম আলোকপ্রাপ্ত এই মানুষদের।

তিনি চেতনাকে জাগিয়ে গেছেন সারাজীবন,সারা পৃথিবীর তাবড় তাবড় দার্শনিকদের কাছে তুলে ধরেছেন ভাবনার নতুন আঙ্গিক। বিশ শতকের গোড়ার দিকের সময়, রোম্যাঁ রোলাঁর মত দার্শনিকের সামনে এই বঙ্গতনয় তুলে ধরেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে মিশে থাকা আধ্যাত্মবাদ। সেই সুরের সাথে মিশেল এঁকে দেন পাশ্চাত্য ধর্মীয় স্তোত্রের সুরের। যেখানে নেই নুন্যতম সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চলে যাওয়ার এত দশক পরে, বাঙালী আজ ঝড় তোলে তাঁর গানে কপিরাইট থাকার পক্ষে-বিপক্ষে। অথচ কবির জীবদ্দশায়, অত বছর  আগেই, কবিগুরুর গানের অনড় রূপ নিয়ে অমত প্রকাশ করেন তিনি। তাঁর মতে, এতে গায়কের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়। কবিগুরুর সাথে মতানৈক্য হলেও, শ্রদ্ধা ছিল আজীবন অমলিন। অতুল প্রসাদ সেন এবং কাজী নজরুলের সাথে ছিল অসম্ভব হৃদ্যতা।

বাংলার রেনেসাঁর সময়েই, ১৮৯৭ সালের ২২ শে জানুয়ারী, এই বাংলায় জন্ম নেন, চিন্তাশীল কবি, প্রাবন্ধিক, পণ্ডিত, সংগ্রাহক, সুরকার, সুগায়ক, সঙ্গীতশাস্ত্রী শ্রী দিলীপ কুমার রায়।বাবা ছিলেন প্রখ্যাত সুরকার, রচয়িতা এবং নাট্যকার শ্রী দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। মাতৃস্নেহ থেকে খুব অল্প বয়েস থেকেই বঞ্চিত হলেও দিলীপ কুমার রায়ের জীবনে বিশাল প্রভাব এসে পড়ে বাবা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের।

শ্রী দিলীপ কুমার রায়ের শুধু সাঙ্গীতিক যাত্রাই ছিল অসম্ভব বৈচিত্রপূর্ণ। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম পেয়েছেন সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, অচ্ছন বাঈ, রাধিকা প্রসাদ গোস্বামী, গৌরীশঙ্কর মিশ্রদের মত প্রবাদপ্রতিম গুরুদের কাছে। এছাড়া ওনার মতে ওনার বাবার প্রভাবে সুরকার হিসাবেও প্রকাশ পায় তাঁর অনন্য শৈলীর নানান রচনা, কখনো বাংলা, কখনো সংস্কৃত আবার কখনো হিন্দি ভাষায়।

গানের সুরের ক্ষেত্রেও রাগসঙ্গীতের পাশাপাশি এসেছে কীর্তনের মত দেশজ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রভাবও। ছেলেবেলায় শেখা “এই বৃন্দাবনের লীলা অভিরাম সবই” গানটি শুনে অবাক হয়ে যেতাম, বাংলা গানে এমন অপূর্ব আখরের উপস্থিতি দেখে। তাঁর ভজনের আকুতি ছুঁয়েছে আসমুদ্রহিমাচল।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, যা সারা বিশ্বে প্রসিদ্ধি পেয়েছে এর স্বতন্ত্রতার জন্য, বনেদীয়ানার জন্য, তেমনই নিন্দা কুড়িয়েছে এর নথিবদ্ধতার অভাবের জন্য। ভাতখন্ডেজী বা দিলীপ কুমার রায় দের মত মানুষ ভাগ্যিস অগ্রণী হয়েছিলেন এই কাজে। দিলীপকুমার রায়, সারা ভারতবর্ষ ঘুরেছেন, সঙ্গ করেছেন সঙ্গীতগুণীদের- লিখে গেছেন সেই বৃত্তান্ত তাঁর  “ভ্রাম্যমানের দিনপঞ্জী” লেখায়।

সুরসম্রাজ্ঞী এম এস শুভলক্ষীর সঙ্গে গাওয়া “ধন ধান্য পুষ্প ভরা” শুনলে কখনো কি মনে হয় যে জীবনের সায়াহ্নে এসে গাওয়া এই গান। তখনও কত দরাজ, সুরে পরিপূর্ণ কণ্ঠস্বর। দিলীপ কুমার রায় তাঁর দীর্ঘ জীবনে দেখে যেতে পারেননি যে তাঁর গান এক আলাদা  শৈলীর গান হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, এই আক্ষেপ রয়ে গিয়েছিল তাঁর সঙ্গে।

Sri Dilip Kumar Roy

আধ্যাত্মিক জীবন উনি নিজেই বেছে নিয়েছিলেন তবে তাতে ছুটি হয়নি তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের, পড়াশুনার বা সঙ্গীতচর্চার।১৯৮০ সালে ছেদ পড়ে এই মহাজীবনের। ছুটি হয়ে যায় কাজের কিন্তু তাঁর বিশাল কাজ থেকে যায়, তাতে কোনদিন আর ফুলস্টপ পড়েনা।

Sri Dilip Kumar Roy
Sri Dilip Kumar Roy

Photo Courtesy: Google

Share this article

Recent posts

Popular categories

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Recent comments