“কভি মুঝকো ইয়াদ করকে………..”

-

ঈশ্বরে বিলীন হলেন ঈশ্বরী। চল্লিশের দশক থেকে আট দশক ধরে ইতিহাস তৈরী করেছেন তিনি। এই ঈশ্বরী শুধু গান গেয়েছেন।প্রথম প্রেমে পড়া কলা বিনুনি বাঁধা কিশোরী থেকে গোলাপি চুলের পিকসি কাটের কিশোরীটিরও, কল্পনায় প্রেমিককে ভেবে ঠোঁটের কোনের হাসি ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। থেমে যাওয়া রূপকথাটা, একদম শেষ হওয়ার  রাতে, বালিশ ভেজানো চোখের জলে মিশে থাকতেন লতা মঙ্গেশকর। বিরানব্বই বছরের কুইন লাইক জীবন অবসানের এক মাস পরেও তবু ‘ছিলেন’ লিখতে গিয়ে হাত কেঁপে ওঠে।

গান গাওয়ার লোকের অভাব কোনদিনই হয়নি ভারতভূমে। তবে কি ছিল এই ভারতরত্নের গানে। ছিল সুর, টিউনিং ফর্কে লেপটে থাকার মত সুর। ছিল সবার কাছে আকাঙ্খিত, ঈর্ষা করার মত এক গলার রেঞ্জ। আবার ওই মিষ্ঠি গলাতে কি অপার জোয়ারি। ছিল প্রতিটা শব্দের প্রতি যত্ন, আদর করে বলা প্রতিটা নিখুঁত শব্দ। ছিল ভাবনা, কে গাইবেন, কোন গানের অভিব্যাক্তি কি হবে, সেই ভাবনা। এবং সেটা সেই সময়ে দাঁড়িয়ে। তাই লতা মঙ্গেশকরের গানে ছিল সুর, আবেগ, কণ্ঠ, বুদ্ধি, উচ্চারণ, নিখুঁত অভিব্যাক্তি আর নায়কীর এক অনন্য সিন্থেসিস।

এই সুবিশাল জয়যাত্রা ফিরে দেখতে গিয়ে আজও চোখ ঝাপসা হয়ে যায় অনেক অনেক গান পাগল মানুষের। তাই ঝাপসা চোখেই এই ফিরে দেখার গল্প। আজ শুধু চল্লিশ আর পঞ্চাশের দশকের দশটি গান আর তাদেরকে ঘিরে গল্প।

এই যাত্রার শুরুতেই যে গানটির প্রসঙ্গ আসে তা সকলেই অনুমান করতে পারেন। ১৯৪৯ সালের মহল ছবির এই গানটি লতা মঙ্গেশকরের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। ক্ষেমচাঁদ প্রকাশের গান ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ বহুযুগ ধরেই শুধু লতা মঙ্গেশকরের গান হয়ে রয়ে গেছে। তবে এই গানটিতে তখনো কোথাও একটু সে যুগের ট্রেন্ড ধরে অনুনাসিক গায়কী রয়ে গেছে।

বহু সাক্ষাৎকারে সুর সম্রাজ্ঞীকে দুঃখ করতে দেখেছি সবাই। বাকায়দা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত না গাইতে পারার গভীর আক্ষেপ ছিল ওনার। সমস্ত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজ্ঞদের প্রতি নিখাদ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, যারা লতা মঙ্গেশকরের বিলম্বিত খেয়াল গান শুনেছেন তাঁরা জানেন মুখরা ধরার অমন নান্দনিকতা আমরা খুবই কম শুনতে পাই। আর যেভাবে উনি সিনেমার গানে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে এঁকেছেন, তাতে শ্রোতাদের কাছে একটাই আক্ষেপ তৈরী হয়েছে যে আরো এমন গান যেন ওনার গলায় শুনতে পাই। যেমন, ১৯৫১ সালের ছবি মল্লারে, রোশনের সুরের এই গানটি।

১৯৫২ সালে, নওশাদের সুরারোপিত বৈজু বাওরা ছবির প্রতিটি গানই মনে হয় অনন্ত বার শুনে যেতে ইচ্ছে করে। বিশেষ করে এই গানের অন্তরায় “…আস  দিলাকে ও বেদরদি, ফেরলি কাহে নজরিয়া” কথাটায় লতা মঙ্গেশকরের আকুতি কাঁদিয়ে চলেছে আজও।

লতা মঙ্গেশকরের গানের গল্প অসম্পূর্ণ থেকে যায় সি রামচন্দ্রজীর গানের কথা না এলে। লতা মঙ্গেশকর নিজে অসম্ভব ভালোবাসতেন সি রামচন্দ্রজীর সুরে গান গাইতে। তাই এই জুটির ১৯৫৩ সালের এই গান অমর হয়ে গেছে। ছবির নাম ‘আনারকলি’ ।

ডুয়েট গানেও লতা মঙ্গেশকরের ম্যাজিক শুরু ওনার কেরিয়ারের প্রথম থেকেই। ছবিতে গান শুনে মনে হত, চূড়ান্ত আবেগে এই মধু গান যেন স্বয়ং নায়িকাই গাইছেন। শঙ্কর জয়কিশনের সুরে, ১৯৫৫ সালের ‘শ্রী ৪২০’  ছবির এই গানটায় যেমন নার্গিস আর লতা মঙ্গেশকর এক হয়ে গেছেন।

এর ঠিক পরের বছরে, ১৯৫৬ সালের ছবি ‘চোরি চোরি’ তে আবার নার্গিস লতা মঙ্গেশকরের জুটি গাইছেন ‘রসিক বালমা’,  আর শুদ্ধ কল্যাণের তানে যেন ঝরে পড়ছে কারুণ্য।

চান্দ ফির নিকলা…, ১৯৫৭ সালের, ‘পেয়িং গেস্ট’ ছবির এই গানটিতে আবার অন্য একরকম নায়কী নিয়ে ধরা দেন লতা মঙ্গেশকর। সুরকার আরো এক ম্যাজিশিয়ন, শচীন দেব বর্মন।

শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন না করতে পারার আক্ষেপের কথা আগেই আলোচনা হয়েছে, এবার শোনা যাক ১৯৫৭ সালেরই ‘সুবর্ন সুন্দরী’ ছবির সেই বিখ্যাত গানটি। চার তুকের প্রতিটিতে চারটে আলাদা রাগ এমন মুনশিয়ানায় হয়েত অনেকেই গাইতে পারেন, কিন্তু পঞ্চাশের দশকে এক টেকে, এমন নান্দনিকতায়,এই ডুয়েট যারা গেয়েছিলেন তাঁরা যে ঈশ্বরতুল্য সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না।

পৃথিবীটা কোনদিন এত সুন্দর হত না, যদি মদন মোহনজীর সাথে লতা মঙ্গেশকরের কোনদিন দেখা না হত। ষাটের দশক ছিল এনাদের স্বর্ণযুগ, সে প্রসঙ্গে পরে আসা হবে, কিন্তু ১৯৫৮ সালের ছবি ‘আদালত’ এ,  লতা মঙ্গেশকরের গলায় আর মদন মোহনজীর সুরে এই গান মাতাল করেনা এমন গান রসিক কি একজনও আছে?

দশকটা প্রায় শেষ হয়ে এল। যুগটাও আস্তে আস্তে এই সময় থেকে পাল্টাতে শুরু করলো।১৯৫৮ সালে এই সুর যেন নতুন হাওয়ার মত আচ্ছন্ন করেছিল সেই সময়টাকে। সলিল চৌধুরীর সুরের এই অসামান্য এই গানটি গাওয়ার জন্যই ১৯৫৯ সালে প্রথম ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পান লতা মঙ্গেশকর। এই গানে অভিনয় করেছিলেন বৈজয়ন্তী মালা, সেই অনুসারেই কণ্ঠস্বর স্থাপনের পরিবর্তনটাও অবাক করার মত।

ক্রমশঃ

Share this article

Recent posts

Popular categories

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Recent comments