“বন্দরে আসি তোর লাইগ্যা…..”

-

গত পৌনে দুই মাসে খুব তাড়াতাড়ি অনেক কিছু ঘটে গেল, যার বেশীরভাগটাই অঘটন। প্রিয় শহর কলকাতায় গান গাইতে এলেন প্রবাদপ্রতিম শিল্পী। অসম্ভব গরমে, অনিয়ন্ত্রিত শীত তাপে, হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে দ্যা শ্যো ওয়েন্ট অন, কিন্তু শিল্পসত্ত্বার এই চিরাচরিত ধারণা কায়েম হলেও পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ থেকে হারিয়ে গেলেন কিংবদন্তী কে.কে। স্তব্ধ হয়ে রইলাম তাঁর গুণমুগ্ধ শ্রোতারা। ডুবে রইলাম, আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম ছোড় আয়ে হাম য়ো গঁলিয়ায়, তড়প তড়পে, খুদা জানে তে, কিঁউ আজকালে আর কলেজে ঠাকুর্দার ক্যান্টিনে ফেলে আসা ইয়ারো দোস্তি এবং এমন অজস্র নস্টালজিক স্তব্ধ পলে।

আরো চূড়ান্ত অঘটন এর আগের রাতেই ঘটে যায়। নিতান্তই কাকতালীয় ভাবে।বাংলার আরেক পরিচিত এবং এযাবৎ অসংখ্য মানুষের ভালোবাসার মানুষ, হয়েতবা কিছুটা অবসাদেই অশিল্পীসুলভ ভাষায় অসন্মান দেখান কেকের প্রতি। বলে ওঠেন “হউ ইজ কে কে ম্যান”। তাসের ঘরের মত  ভেঙে পড়ে রূপঙ্কর বাগচীর এতদিনের অবদান, এত সুর, এত গান। শুধু শিল্পী হিসাবে নয়, মানুষ হিসাবেও একই পেশার আরেক শিল্পীর এই অবমাননা সত্যিই সমর্থনযোগ্য নয়। তবে পরের দিনই কেকের অকালমৃত্যুতে উপচে পরে আরো লাখ লাখ শ্রোতার বাক্যবাণ। চলতে থাকে নোংরা ট্রোলিং, গান বয়কটের দাবী আরো কত কি। প্রত্যাখ্যান করা হয় এক বিপণীর জন্য গাওয়া শিল্পীর জিঙ্গল। অত্যন্ত গরমে আবার রোদ্দুর রায় এসে পড়েন, অশ্রাব্য ভাষায় লাইভ হয়, যা শুনে কেউ আরো অশ্রাব্য ভাষা প্রয়োগ করেন, আবার কেউ কেউ বলেন কথাগুলো কিন্তু ভুল বলেননি। রূপঙ্করের পক্ষ বিপক্ষ মেতে ওঠেন। কেউ বলেন আর শুনবই  না ওর গান, কেউ বলে ওঠেন বন্ধ হোক এই ট্রোলিং। আবার পড়লাম লোকজন এও লিখছেন যে কেকের নাকি শেষের দিকটায় সুর লাগছিল না। প্রমাণমূলক ভিডিও চাওয়ায় তা পাওয়া গেলনা। যে যেমন পারলেন কথা ভাসিয়ে গেলেন।

এরই দিনকতক পর আমরা ভেসে গেলাম আর এক প্লাবনে। প্লাবনের নাম অরিজৎ সিং,  আরেক বঙ্গসন্তান। লতা মঙ্গেশকরকে শ্রদ্ধা জানালেন তাঁর গানে, এক ন্যাশানাল চ্যানেলের আমন্ত্রণে। অন্যান্য অনেক গানের মধ্যেই প্লাবন আনলো হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের সুরে এবং সলিল চৌধুরীর কথায় সেই গান। বাংলা এবং মারাঠী ভাষা মিলিয়ে। সেই দোল ভাসিয়ে নিয়ে গেল আপামোর ভারতবর্ষকে। সর্বত্র বেজে উঠলো “চল ভাসি সব কিছু তাইগ্যা”। এমন নরম প্রতিবাদ মনে হয় শুধু শিল্প দিয়েই হয়, যার আগুন ছড়িয়ে যায় আট থেকে আশীর মনে। কি অসামণ্য যন্ত্রানুসঙ্গ। অরিজিৎ সিং এর ভাবপূর্ণ উপস্থাপনের প্রেমে পড়ে যাই সকলে। কাজের ফাঁকেই গাড়িতে বাজতে থাকে অরিজিৎ সিং এর “দে দোল দোল দোল”।আদর করে শুনতে থাকি তিন প্রজন্ম।   

সেই গানে মত্ত অবস্থাতেই মাথায় চাগাড় দিতে থাকে “ হেঁইয়ো রে মার দোল হে আল্লা রে রামা”। মাথায় ঘুরতে থাকে মূল গানটায় এই মেলোডির সাথে  অনবদ্য হারমোনি লাইনগুলো। বহু বছর পর শুনতে থাকি আবার আসল কম্পোজিশনটা। অ্যানালগ রেকর্ডিং, তাতে অমন কোরাস, যা শুনলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, কি অপূর্ব রিদম সেকশন, তেমনি মেলোডি। প্রথম আলোর মত এসে পড়ছে লতা মঙ্গেশকরের গলা! “হায় তোমারি অবলা শুধু মুই নারী”!! এ জোয়ারির উৎস কোথায়!! আর পুরো গানটা ভরাট করে রয়েছেন, গানটার প্রাণভোমরা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। যেমন কণ্ঠস্বর, তেমনি স্বর লাগানো। তার সপ্তকে আর মন্দ্র সপ্তকে একইরকম এফর্টলেস গলা ফেলছেন। কোথাও নাটক বেশী হচ্ছে না, গলার স্বর পাল্টাচ্ছে না, অথচ ভেতরটা অবধি ছুঁয়ে যাচ্ছে এই কথাগুলোর আবেদন।

 “কেন পিছু ডাকো পিছু ডাকো

বারে বারে আমারে তুমি

কান্দো কন্যা তুমি

চক্ষের জলে কি ভাসাবে

সাধের ও জমি”

আজ শ্রী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একশ দুই বছরের জন্মদিন।পঞ্চাশের দশকের গোড়ার থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সারা ভারতবর্ষের গান পাগল কোটি কোটি  মানুষকে।সোশ্যাল মিডিয়া ছিলনা, তবু গান রিলিজ হওয়া মাত্র সেইসব গান ভাইরাল হয়ে যেত। এমনি ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরের জাদু আর অনন্য কণ্ঠস্বর। অসীম বুদ্ধিতে রপ্ত করেছিলেন স্টুডিও এবং স্টেজে মাইক্রোফোন ব্যবহারের সুনিপুণ কৌশল। যারা ওনাকে সামনে থেকে মাইক্রোফোনে গাইতে দেখেছেন তাদের  আজও সেই ঘোর কাটেনি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ভালবেসেছেন  শুধু বাংলা নয় সারা দেশের মানুষ। দেশ বিদেশের কোথাওই তাঁকে নিয়ে উত্তেজনা দেখাতে কার্পণ্য করেননি কোন গান পাগল মানুষ। চাকচিক্যহীন পোশাকে, নামমাত্র কথা আর শুধুমাত্র প্রাণছোঁয়া অসংখ্য গান গেয়ে মানুষের মনে থেকে গেছেন শতবর্ষ পরেও। টালমাটাল সময়ের সিম্ফনী বা ক্যাকফনীর মধ্যে যার গানে ফিরে আসতে হয় নিশ্বাস নেওয়ার জন্য।

Share this article

Recent posts

Popular categories

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Recent comments